সুখী মানুষ (মমতাজ উদ্‌দীন আহমেদ)

অষ্টম শ্রেণি (দাখিল) - সাহিত্য কণিকা (বাংলা) গদ্য | - | NCTB BOOK
564
564

                                                                                                                               চরিত্র পরিচিতি

                                                                                                                         নাম                     বয়স 

                                                                                                                      মোড়ল                      ৫০     

                                                                                                                    কবিরাজ                     ৬০

                                                                                                                          হাসু                       ৪৫

                                                                                                                        রহমত                      ২০

                                                                                                                         লোক                       ৪০ 

                                                                                                                                              (প্রথম দৃশ্য) 

[মোড়লের অসুখ । বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। কবিরাজ মোড়লের নাড়ি পরীক্ষা করছে। মোড়লের আত্মীয় হাসু মিয়া আর মোড়লের বিশ্বাসী চাকর রহমত আলী অসুখ নিয়ে কথা বলছে ।]

 

হাসু : রহমত, ও রহমত আলী।

হাসু : রহমত, ও রহমত আলী।

হাসু : ভালো করে শোনো, ঐ কবিরাজ যতই নাড়ি দেখুক, তোমার মোড়লের নিস্তার নাই ।

রহমত : অমন ভয় দেখাবেন না। তাহলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লেগে যাব

হাসু : কাঁদ, মন উজাড় করে কাঁদ। তোমার মোড়ল একটা কঠিন লোক । আমাদের সুবর্ণপুরের মানুষকে বড় জ্বালিয়েছে। এর গরু কেড়ে, তার ধান লুট করে তোমার মোড়ল আজ ধনী। মানুষের কান্না দেখলে হাসে ।

রহমত : আর আজে-বাজে কথা বলবেন না। আপনি বাড়ি যান!

কবিরাজ : এত কোলাহল করো না। আমি রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করছি।

রহমত : ও কবিরাজ, নাড়ি কী বলছে! মোড়ল বাঁচবে তো !

কবিরাজ : মূর্খের মতো কথা বল না। মানুষ এবং প্রাণী অমর নয়। আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে তাই শ্রবণ কর ।

হাসু : আমাকে বলুন। মোড়ল আমার মামাতো ভাই ।

রহমত : মোড়ল আমার মনিব ।

কবিরাজ : এই নিষ্ঠুর মোড়লকে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে একটি কঠিন কর্ম করতে হবে।

হাসু বাঘের চোখ আনতে হবে?

কবিরাজ : আরও কঠিন কাজ ।

রহমত : হিমালয় পাহাড় তুলে আনব?

কবিরাজ : পাহাড়, সমুদ্র, চন্দ্র, নক্ষত্র কিছুই আনতে হবে না ৷

মোড়ল : আর সহ্য করতে পারছি না। জ্বলে গেল। হাড় ভেঙে গেল। আমাকে বাঁচাও ।

কবিরাজ : শান্ত হও। ও রহমত, মোড়লের মুখে শরবত ঢেলে দাও।

         

                                                                                                                      (রহমত মোড়লকে শরবত দিচ্ছে।)

হাসু : ঐ মোড়ল জোর করে আমার মুরগি জবাই করে খেয়েছে। আমি আজ মুরগির দাম নিয়ে ছাড়ব।

মোড়ল : ভাই হাসু এদিকে এস, আমি সব দিয়ে দেব। আমাকে শান্তি এনে দাও।

কবিরাজ : মোড়ল, তুমি কি আর কোনোদিন মিথ্যা কথা বলবে?

মোড়ল : আর বলব না । এই তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন মানুষের ওপর জবরদস্তি করব না। আমাকে ভালো করে দাও।

কবিরাজ : লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর কোনোদিন লোভ করবে?

মোড়ল : না । লোভ করব না, অত্যাচার করব না। আমাকে শান্তি দাও। সুখ দাও।

কবিরাজ : তাহলে মনের সুখে শুয়ে থাক, আমি ওষুধের কথা চিন্তা করি।

মোড়ল : সুখ কোথায় পাব? আমাকে সুখ এনে দাও।

হাসু : অন্যের মনে দুঃখ দিলে কোনোদিন সুখ পাবে না ।

মোড়ল : আমার কত টাকা, কত বড় বাড়ি! আমার মনে দুঃখ কেন?

কবিরাজ : চুপ কর। যত কোলাহল করবে তত দুঃখ বাড়বে। হাসু এদিকে এস, আমার কথা শ্রবণ কর ৷ মোড়লের ব্যামো ভালো হতে পারে, যদি...

রহমত : যদি কী?

কবিরাজ : যদি আজ রাত্রির মধ্যেই-

হাসু : কী করতে হবে?

কবিরাজ : যদি একটি ফতুয়া সংগ্রহ করতে পার।

রহমত : ফতুয়া?

কবিরাজ : হ্যাঁ, জামা । এই জামা হবে একজন সুখী মানুষের। তার জামাটা মোড়লের গায়ে দিলে, তৎক্ষণাৎ তার হাড় মড়মড় রোগ ভালো হবে । 

রহমত : এ তো খুব সোজা ওষুধ।

কবিরাজ : সোজা নয়, খুব কঠিন কাজ। যাও, সুখী মানুষকে খুঁজে দেখ । সুখী মানুষের জামা না হলে অসুখী মোড়ল বাঁচবে না।

মোড়ল : আমি বাঁচব । জামা এনে দাও, হাজার টাকা বখশিশ দেব।

                                                                                                                                          (দ্বিতীয় দৃশ্য)

[বনের ধারে অন্ধকার রাত। চাঁদের ম্লান আলো। ছোট একটি কুঁড়েঘরের সামনে হাসু মিয়া ও রহমত গালে হাত দিয়ে ভাবছে।]

রহমত : কী তাজ্জব কথা, পাঁচ গ্রামে একজনও সুখী মানুষ পেলাম না। যাকেই ধরি, সেই বলে, না ভাই, আমি সুখী নই।

হাসু : আর তো সময় নাই ভাই, এখন বারোটা। সুখী মানুষ নাই, সুখী মানুষের জামাও নাই। মোড়ল তো তাহলে এবার মরবে।

রহমত : আহা রে, আমরা এখন কী করব! কোথায় একটা মানুষ পাব, যে কিনা—

হাসু : পাওয়া যাবে না। সুখী মানুষ পাওয়া যাবে না। সুখ বড় কঠিন জিনিস। এ দুনিয়াতে ধনী বলছে, আরও ধন দাও; ভিখারি বলছে, আরও ভিক্ষা দাও; পেটুক বলছে, আরও খাবার দাও । শুধু দাও আর দাও। সবাই অসুখী। কারও সুখ নেই।

রহমত : আমরাও বলছি, মোড়লের জন্য জামা দাও, আমাদের বখশিশ দাও। আমরাও অসুখী।

হাসু : চুপ চুপ! ঘরের মধ্যে কে যেন কথা বলছে।

রহমত : ভূত নাকি? চলেন, পালিয়ে যাই। ধরতে পারলে মাছভাজা করে খাবে।

হাসু : এই যে, ভাই। ঘরের মধ্যে কে কথা বলছ? বেরিয়ে এস।

রহমত : ভূতকে ডাকবেন না । 

                                                                                                                      [ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো ।]

লোক : তোমরা কে ভাই? কী চাও?

হাসু : আমরা খুব দুঃখী মানুষ । তুমি কে?

লোক : আমি একজন সুখী মানুষ। 

হাসু : আঁ! তোমার কোনো দুঃখ নাই?

লোক : না। সারা দিন বনে বনে কাঠ কাটি। সেই কাঠ বাজারে বেচি। যা পাই, তাই দিয়ে চাল কিনি, ডাল কিনি। মনের সুখে খেয়ে-দেয়ে গান গাইতে গাইতে শুয়ে পড়ি। এক ঘুমেই রাত কাবার ।

হাসু : বনের মধ্যে একলা ঘরে তোমার ভয় করে না? যদি চোর আসে?

লোক : চোর আমার কী চুরি করবে?

হাসু : তোমার সোনাদানা, জামাজুতা?

                                                                                                                           (লোকটি প্রাণখোলা হাসি হাসছে)

রহমত : হা হা করে পাগলের মতো হাসছ কেন ভাই!

লোক : তোমাদের কথা শুনে হাসছি। চোরকে তখন বলব, নিয়ে যাও, আমার যা কিছু আছে নিয়ে যাও ।

হাসু : তুমি তাহলে সত্যিই সুখী মানুষ।

লোক : দুনিয়াতে আমার মতো সুখী কে? আমি সুখের রাজা। আমি মস্ত বড় বাদশা ।

রহমত : ও বাদশা ভাই, তোমার গায়ের জামা কোথায়? ঘরের মধ্যে রেখেছ? তোমাকে একশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস।

লোক : জামা!

রহমত : জামা মানে জামা! এই যে, আমাদের এই জামার মতো জিনিস। তোমাকে পাঁচশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস, মোড়লের খুব কষ্ট হচ্ছে।

লোক : আমার তো কোনো জামা নাই ভাই!

হাসু : মিছে কথা বল না।

লোক : মিছে বলব কেন? আমার ঘরে কিছু নাই। সেই জন্যই তো আমি সুখী মানুষ।

 

 

common.content_added_and_updated_by

শব্দার্থ ও টীকা

331
331

কবিরাজ  বৈদ্য; আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে যিনি চিকিৎসা করেন।

নাড়ি পরীক্ষা  কবজির ধমনির গতি দেখে রোগ নির্ণয়। 

মূর্খ  নির্বোধ, বোকা, অজ্ঞ।

শ্রবণ  কানে শোনা।

জবরদস্তি — জোরাজুরি ।

ব্যামো — অসুখ, রোগ, ব্যারাম ।

তাজ্জব  অদ্ভুত, বিস্ময়কর।

প্ৰাণখোলা  অকৃত্রিম, উদার, খোলা মনের।

common.content_added_by

পাঠের উদ্দেশ্য

294
294

এ নাটিকা পাঠ করে শিক্ষার্থীরা উপলব্ধি করবে যে, অন্যায় ও অনৈতিকভাবে উপার্জিত অর্থ-বিত্তই মানুষের অশান্তির মূল কারণ। বরং সৎ পথে নিজ পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকানির্বাহ করলেই জীবনে শান্তি মেলে। সুতরাং নীতিহীন পথে সম্পদ উপার্জনের পথ পরিহার করাই উত্তম।

common.content_added_by

পাঠ-পরিচিতি

299
299

'সুখী মানুষ' মমতাজউদদীন আহমদের একটি নাটিকা। এর দুটি মাত্র দৃশ্য। নাটিকাটির কাহিনিতে আছে, মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে, ধনী হওয়া এক মোড়লের জীবনে শান্তি নেই। চিকিৎসক বলেছেন, কোনো সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলে মোড়লের অসুস্থতা কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ গ্রাম খুঁজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল না।

শেষে একজনকে পাওয়া গেল, যে নিজের শ্রমে উপার্জিত আয় দিয়ে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে সুখে দিন কাটাচ্ছে । তার কোনো সম্পদ নেই, ফলে চোরের ভয় নেই। সুতরাং শান্তিতে ঘুমোনোর ব্যাপারে তার কোনো দুশ্চিন্তাও নেই। শেষ পর্যন্ত সুখী মানুষ একজন পাওয়া গেলেও দেখা গেল তার কোনো জামা নেই। সুতরাং মোড়লের সমস্যার সমাধান হলো না। নাটকের মূল বক্তব্য - সম্পদই অশান্তির কারণ। সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের অনেক সম্পদ থেকেও সুখ নেই। আবার আরেকজনের কিছু না থাকলেও সে সুখী থাকতে পারে।

common.content_added_by

লেখক-পরিচিতি

337
337

মমতাজউদদীন আহমদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা শেষে ১৯৯২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা— নাটক : ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা', 'রাজা অনুস্বারের পালা', 'সাত ঘাটের কানাকড়ি', ‘আমাদের শহর’, ‘হাস্য লাস্য ভাষ্য'; প্রবন্ধ-গবেষণা : 'বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত', 'বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত' ইত্যাদি । সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ রা জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।

common.content_added_by

বহুনির্বাচনি প্রশ্ন

341
341
common.please_contribute_to_add_content_into বহুনির্বাচনি প্রশ্ন.
common.content

সৃজনশীল প্রশ্ন

312
312
common.please_contribute_to_add_content_into সৃজনশীল প্রশ্ন.
common.content
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion